ভালোবাসার সাইক্লিক অর্ডার (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-২)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৮:০৪:৫৯ সকাল
পাভেলের ঘুম খুব পাতলা। রাস্না অনেক রাত পর্যন্ত নেটে কাজ করে। ল্যাপটপের মৃদু সাউন্ডও পাভেলের ঘুমকে নষ্ট করে দেয়। কিন্তু সে বিরক্ত হয় না। বরং জেগে উঠে রাস্নার পাশে থাকতে পারছে- ওকে দেখতে পারছে এই বোধটা ওকে আনন্দ দেয়।
রাস্না কি বুঝতে পারে?
মনে হয় না। তাহলে ওকে অবশ্যই বলত। এখন এমন কিছু নেই বিশেষ করে পাভেলের ব্যাপারে, যেখানে রাস্না কমেন্ট করবে না। এই যে ঘুমের ভান করে ওকে দেখে, জানলে বলত, ‘ মটকা মেরে পড়ে না থেকে যা দেখার সরাসরি দেখ’।
ওদের বিয়েটাও দুজনের পছন্দতে হয়েছিল। দুই ছেলেকে নিয়ে পাভেল-রাস্নার দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল বসন্তের পাতা ঝরার দিনগুলোর মত । কিন্তু রামপুরার বাসাটা ছেড়ে দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটির পান্ধোয়া এলাকার এই নিরিবিলি বাসাটাতে আসার পর থেকেই একটা একটা করে সুতোগুলো ছিড়ে যেতে লাগল। ভাললাগা থেকে যে সম্পর্কের সুত্রপাত- যার জন্য সকল পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করে দুজনে এক হতে অনেক মুল্য দিয়েছিল। সেই ভালবাসার রঙিন সুতো গুলো এতই পলকা হয়ে গেল? এতোটাই বিবর্ণ ? এতো ঠুনকো কেন?
ওর প্রিয়তমা আজ ইদানিং রাত জেগে অন্য কারো হৃদয়ে ঝড় তুলছে। কার হৃদয়ে সেটাও সে জানে। কিন্তু এ ব্যাপারে এখনো রাস্নাকে কিছুই বলে নাই। আদতে যে সে জানে সেটাও বুঝতে দেয় নি। নিজের ভিতরে অসহ্য কষ্টকে পুষে রেখে চলেছে... একজন পুরুষের জন্য এর থেকে কষ্টকর আর কিছু কি হতে পারে? না পারছে কারো সাথে শেয়ার করতে?
এই যে এখন রাস্না রাহাতের সাথে চ্যাটে বসেছে। এখনকার মুহুর্তগুলোতে ওর চেহারায় রহস্যময় ভাবের খেলা চলছে। চোখের ভিতর কি এক সুতীব্র আলোকময় রশ্মি! একসময় এগুলো ওর হৃদয়ে পড়ত এসে। নাকের নীচে হাল্কা কিছু ঘাম জমেছে। বু্কের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল পাভেলের। ইচ্ছে করছে উঠে রাস্নাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সব ওলট-পালট করে দিতে। সেই প্রথম দিনগুলোর মত... এখনো তো সেই ঝড় ওর বুকে রয়ে গেছে। কিন্তু কেন – কিসের এক পিছু টানে সে সামনে আগাতে পারছে না।
পাভেল অনেক দিন আগের একটা সময়ে ফিরে গেল।
একটা ভুল... সেটাই কি রাস্নাকে ওর এই আজকের অবস্থানে এনেছে?
রাস্নার পাশে থেকেও যোজন যোজন দুরত্তে রয়েছে সে।
ওহ! যদি এক লহমায় এটা কাটানো যেত!!
... ...
পাভেল এক বর্ষাকালে ফিরে যায়। আরো পাঁচ বছর আগের ঘটনা। রামপুরার বনশ্রী প্রোজেক্টে থাকে। পরিবারে দুবাচ্চা আর রাস্না- মাঝে মাঝে রাস্নার ছোট বোন এসে ক'দিনের জন্য বেড়িয়ে যায়। সে ইডেনে পড়ে। দুলহা ভাই ও শ্যালিকার ভিতরে অনেক মজার সম্পর্ক থাকলেও সেটা যদি সীমানা অতিক্রম করে তবে সকলের নিকট তা দৃষ্টিকটু। তা না হলে এই সম্পর্ক সকলের নিকট আনফিসিয়ালি অফিসিয়াল বউ এর মতই।
ব্যবসার কাজে পাভেলকে দিন-রাত পরিশ্রম করতে হচ্ছে। বৃদ্ধ বাবা-মা এবং ছোট দুই ভাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকা পরিবারটিকেনও সে দেখে। কত বলেছে ঢাকার বাসায় এসে বাবা-মাকে ওদের সাথে থাকতে। কিন্তু তাদের অমতে বিয়ে করাতে বাবা সেই যে রেগে আছেন- আজ পর্যন্ত বাবাকে মানাতে পারে নি। তবে সবার জন্য ছেলে ও ভাই হিসেবে যা যা করণীয়, সে ১০০ ভাগ করার চেষ্টা করে এসেছে। এ জন্য নিজের উপর ওর একটা আত্মতৃপ্তিও রয়ে গেছে।
একদিন ইভানা কয়েকদিন থাকবে বলে বোনের বাসায় এলো। পাভেল তখন রাতে ছাড়া বাসায় আসতে পারে না। এসে খাওয়া দাওয়া সেরে ক্যাবল টিভিতে এইচ বি ও চ্যানেলে অনেক রাত পর্যন্ত ইংরেজী মুভি দেখে। রাস্না অপেক্ষা করে করে বিরক্ত হয়। তবে প্রায় সময়ই ড্রয়িং রুমে ওদের একান্ত কাছে আসার সময়টা কাটে। এটাও রাস্নার কাছে অন্য রকম ভাল লাগত। ইভানা রাস্নার সব থেকে ছোট বোন। ও আসার পরে পাভেলের রাস্নার সাথে একান্তে সময় কাটাতে সমস্যা হতে থাকে। রাস্না মেনে নিলেও পাভেলের কষ্ট হত।
অবশেষে.....
প্রচন্ড বর্ষার এক রাতে ব্যবসায়িক ডেলিগেটদের এক পার্টি থেকে একটু বেসামাল অবস্থায় পাভেল বাসায় ফিরে। সেদিনই রাস্নার প্রচন্ড মাইগ্রেনের ব্যাথা উঠেছে। কোনোমতে বেড রুমে বাচ্চা দুটিকে নিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। ইভানা একা জেগে। আর ওর পরা ড্রেসটা ও ছিল রাস্নার- পাভেলের অন্যতম প্রিয় একটা কালার।পাভেল খেয়েই এসেছিল। সোজা ড্রয়িং রুমে চলে যায়। টিভির সামনে। একটা হিন্দী চ্যানেলে গানের অনুষ্ঠান হচ্ছে। ইভানার শরীরে রাস্নার পারফিউম... চেহারাও দু বোনের প্রায় একই... ড্রেসটাও রাস্নার। পাভেলের মাথাটা কাজ করে না। সে সোফায় বসা ইভানাকে রাস্না মনে করে এগিয়ে যায়। পাভেলের চোখে ইভানা তখন রাস্নায় রুপ নিয়েছে। ইভানা প্রথমে মনে করে দুলহা ভাইয়ের হাল্কা রসিকতা। কিন্তু ক্রমেই পাভেল মদ্যপ অবস্থায় স্বাভাবিক মানুষ থেকে হিংস্র মানুষে পরিণত হতে থাকে। বাহিরে বৃষ্টির একটানা ঝরঝর বর্ষনে পাভেলের ভিতরের জেগে উঠা পশুত্বকে থামানোর মতো কোনো শক্তি ইভানার ছিল না। আর পাভেলও তার অস্বাভাবিক চিন্তার ভিতরে রাস্নাকেই মনে করে অবগাহন করছিল।একসময় ঘরের ভিতরের ঝড় থেমে যায়। বাহিরের ঝড় তখনো চলছিল- অনাগত আরো একটা ঝড়ের অপেক্ষায়। মাইগ্রেণের ব্যথাটা একটু কমাতে রাস্না ড্রয়িং রুমে এসে বিপর্যস্ত ছোট বোন ও পাভেলের অনুতপ্ত চেহারা... লন্ডভন্ড সোফা... সব কিছু রাস্নাকে হতবাক করে দেয়। ঘৃনায় পাভেলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ইভানাকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায় রাস্না।
আজ বিছানায় শুয়ে শুয়ে পাভেল রাস্নাকে দেখছে আর সেই রাতের কথা চিন্তা করছে। কিন্তু জীবনের সেই প্রথম পদস্খলন রাস্না তো পরে বুঝতে পেরেছিল। ওকে ক্ষমাও করেছিল। কিন্ত মনের দিক থেকে কি সে মেনে নিয়েছিল? হয়ত... হয়ত না। কিন্তু সেই পাঁচ বছর আগের ঘটনার রেশ কি এখন চলছে? তা ও বা কিভাবে হয়?
তবে রাস্নাকে সে ভালবাসে এখনও সেই বিয়ের আগের দিনগুলোর মতই... রাহাতের সাথে সম্পর্কের কথা জেনেও।
কিন্তু রাস্না কি তা জানে?
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
৯৩৪ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চমৎকার ভাবে দাম্পত্য জীবনের কঠিনতা গুটিয়ে তুলায় ধন্যবাদ ........
লেখালেখির কতদূর?
এই মুহুর্ত থেকেই শুরু করে দিন।
আপনার লেখা পড়বার অপেক্ষায় রইলাম।
অনেক শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন